মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
শিরোনাম : * আর্থিক খাতে সংস্কার অব্যাহত থাকবে : অর্থ উপদেষ্টা   * স্বৈরাচারের দোসরদের যড়যন্ত্রের বিষয়ে সতর্ক থাকুন : তারেক রহমান   * বিএনপি মহাসচিবের সাথে অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের বৈঠক   * ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের নতুন ডিসি মুহাম্মদ তালেবুর রহমান   * তিন সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুতের লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতির আশা উপদেষ্টার   * আইন কেউ নিজের হাতে তুলে নিবেন না : প্রধান উপদেষ্টা   * নড়াইলে মাশরাফিসহ ৯০ জনের নামে মামলা   * পোশাক শ্রমিকদের বকেয়া বেতন বৃহস্পতিবারের মধ্যে পরিশোধ   * সংস্কারের জন্য প্রাথমিকভাবে ৬টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি : প্রধান উপদেষ্টা   * ডেঙ্গুতে আরও তিনজনের মৃত্যু, আক্রন্ত ৪০৩ জন  

   সম্পাদকীয়
একুশ মানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো
  Date : 20-02-2019

ডাঃ মোঃ শহীদুল্লাহ সিকদার :

বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির ইতিহাসে একুশে ফেব্রæয়ারি এক অবিস্মরণীয় দিন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ঐতিহাসিক দিন একুশে ফেব্রæয়ারি। এ দিনের ইতিহাস আমাদের সংগ্রামী চেতনার ইতিহাস। এ দিন বাঙালীর জাতীয় জীবনের পরবর্তী সকল আন্দোলনের প্রেরণার উৎস। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক আবুল ফজল লিখেছিলেন ‘একুশ মানে মাথা নত না করা।’ একুশ মানে মাতৃভাষকে সম্মানের সঙ্গে শ্রদ্ধার আসনে বসানো। একুশ মানে ভাষার জন্য জীবন ও রক্ত দেয়ার দিন। একুশ আমাদের মহান শহীদ দিবস। তাই এ দিনটিকে আমরা ভুলতে পারি না। একুশে ফেব্রæয়ারির ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন। একুশের পথ ধরে আমরা পেয়েছি ৫৪ এর নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। এসব আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। যার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ’৭৫-এ জাতির জনকের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশী-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আবার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার লাভ করে। তাই বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, ‘বাঙালী জাঁতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছে- এই জাঁতি উন্নত সমৃদ্ধ জাঁতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য, তাঁর নেতৃত্বে অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও অন্যান্য সামাজিক সূচকে বিশ্ব মন্দার কালেও সা¤প্রতিক সাফল্যগুলো তার পরিচায়ক। তাই আজকে একুশের মূল প্রেরণা উদার বাঙালী জাতীয়তাবাদী অসা¤প্রদায়িক চেতনাই আমাদের বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ‘একুশ মানে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো।’
বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলনের প্রথম থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত অবিচল ও দূর দৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর অকুতোভয় নেতৃত্বেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষার উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও বিকাশে তার পদক্ষেপ ছিল অনন্য ও উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধু ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন যার জন্য পাকিস্তানের কায়েমি শাসক এবং নেতৃবৃন্দ ছিলেন তার নখদর্পণে। তাদের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি সম্পর্কে তাঁর পরিষ্কার ধারণা ছিল- এ ভাষা আন্দোলন তার কাছে মাত্র একটি আন্দোলন বিশেষ ছিল না। ছিল জাতির অস্তিত্বের জাগরণকাল। বাকস্বাধীনতার অভ্যন্তরে নির্মিত রাজনৈতিক স্বাধীনতার বীজ বপনকাল।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই পাঞ্জাবী শাসকচক্র প্রথম আঘাত হানে বাঙালীর মাতৃভাষার ওপর। পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলাকে অস্বীকার করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালায় পাকিস্তানী সরকার। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের নেতাদের ভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হলে বাংলার মানুষ নীরবে বসে থাকেনি। তাঁরা পাকিস্তানের শাসকদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের প্রতিফলন ঘটে ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের গণপরিষদের ভাষণে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি করাচীতে পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশণে কংগ্রেস দলীয় নেতা শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ বলেন, যে, উর্দু ইংরেজীর সঙ্গে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের অধিকার থাকতে হবে। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রæয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষা সম্পর্কীয় বক্তব্যের ওপর আলোচনা হয়।
শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের গণপরিষদের বক্তব্য বাংলার ছাত্র-যুবক-শিক্ষকসহ সকলকে প্রচ-ভাবে ভাষার আন্দোলনে উৎসাহ যোগায় এবং ভাষা আন্দোলনের নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে। করাচীর গণপরিষদের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার সংবাদ ঢাকায় পাওয়ার পর প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক ও বুদ্ধিজীবী প্রচ- বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তখন বঙ্গবন্ধু বেশ কিছু প্রগতিশীল ছাত্র ও যুবক নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাষার দাবিকে জোরালো করার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এ লক্ষ্যে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন প্রগতিশীল অসা¤প্রদায়িক সংগঠনের কর্মীরা ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে এক সভায় মিলিত হন। কামরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে এই সভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, রনেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখ। সভায় গণপরিষদের সিদ্ধান্ত এবং মুসলিম লীগের বাংলা ভাষা বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রস্তাবে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বাংলা ভাষা নিয়ে মুসলিম লীগ সরকারের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহŸান করে। ধর্মঘট চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেন। এখান থেকে তাঁকে পুলিশ গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গ্রেফতারের প্রতিবাদে সারা দেশের ছাত্র সমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মুসলিম লীগ সরকার ছাত্র সমাজের আন্দোলনের চাপে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ বন্দীদের মুক্তি দিতে রাজি হয়।

১৯৪৮ সালের প্রথম দিক থেকে ভাষা আন্দোলনের যে তীব্র আকার ধারণ করে সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভ‚মিকা ছিল। ভাষা আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিরলস পরিশ্রম করেন। সেই সময়ে আরও যে সমস্ত ছাত্র যুবনেতা ভাষার দাবির আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, আবদুল মতিন, মোহম্মদ তোয়াহা, শওকত আলী, নঈমুদ্দিন আহমদ প্রমুখ।
বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে যখন বাংলার মানুষ সোচ্চার ঠিক সেই সময়েই ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ এম এ জিন্নাহ ঢাকা সফরে আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় এম এ জিন্নাহ ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তাঁর এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করে ওঠেন সভার এক প্রান্তে থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তাজউদ্দীন আহমদ ও আবদুল মতিন। এর তিন দিন পর জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের কার্জন হলে যান সমাবর্তন উৎসবে। সেখানে ভাষণ দিতে গিয়ে আবার সেই একই কথা জোর দিয়ে বললেন, উর্দুই হবে একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্টভাষা। সবাই একবারে প্রতিবাদ করে ওঠেন। এতে জিন্নার কণ্ঠ তলিয়ে যায় ফলে জিন্নাহ ক্ষোভে-দুঃখে অপমানে কিছু সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর আবার তিনি ভাষণ শুরু করেন। তবে এবার কথা বলেন অনেকটা নরম সুরে।
এরপর এম এ জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ডাকেন। জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনার জন্য এক প্রতিনিধি দল যান। জিন্নাহ সাহেব তখন মিন্টো রোডে তৎকালীন প্রধান সচিব আজিজ আহম্মদের বাসায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে জিন্নাহর সঙ্গে প্রতিনিধি দল মিলিত হন এবং আলোচনা করেন। জিন্নাহর অনুমতিক্রমে তাঁর সামনে স্মারকরিপি পাঠ করেন কামরুদ্দিন সাহেব। স্মারক লিপির কিছু অংশ পাঠ করার পর জিন্নাহ সাহেব ক্রুদ্ধ কণ্ঠে স্মারকরিপি পাঠ করতে নিষেধ করেন। প্রতিনিধি দলের কোন কথা না শুনে জিন্নাহ একতরফাভাবে প্রতিনিধি দলের সদস্যদের ভারতের দালাল বলে গালি দেন। তিনি এক রাষ্ট্র, এক ধর্ম, এক ভাষার কথা বললে তাঁর সামনেই প্রতিনিধি দল তীব্র প্রতিবাদ জানান, চলে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে জিন্নাহর তর্কাতর্কি। প্রতিনিধি দলের প্রশ্নে ক্রুদ্ধ হয়ে জিন্নাহ আলোচনাসভা ত্যাগ করার হুমকি দেন। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্ধ নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাঁদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন বলে জিন্নাহকে জানিয়ে আসেন। জিন্নাহর গোয়ার্তুমি নাজিমুদ্দিন ও নূরুল আমিনের অনুসরণ করাই ভাষা আন্দোলনকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।
মুসলিম লীগ সরকারের বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে তৎপরতার প্রতিবাদে ছাত্র যুবকদের মাঝে ভাষার দাবির আন্দোলন শক্তিশালী হতে থাকে। এ অবস্থা মোকাবেলার জন্য মুসলিম লীগ সরকার দমন নীতির পথ বেছে নেয়। সরকারের সব প্রকার দমন নীতিকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছাত্র-যুব শক্তিকে সংগঠিত করেন ভাষা আন্দোলনকে একটি গণআন্দোলনে রূপান্তরিত করার জন্য। তিনি যতই সংগঠিত হতে লাগলেন ততই মুসলিম লীগ সরকারের কোপনালে পড়তে লাগলেন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বও তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৯ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট ডাকা হয়। ওইদিন ছিল সরকারের বাজেট অধিবেশন। এর কয়েকদিন আগে থেকেই চলে ভাষার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচী। ক্রমশই ভাষার দাবিতে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় ২১ ফেব্রæয়ারির ধর্মঘটের প্রস্তুতি দেখে সরকার বুঝতে পারে তাঁদের অবস্থা ক্রমশই বেগতিক হচ্ছে। নাজিমুদ্দিন সরকার ভাষার আন্দোলনকে দমানোর জন্য ২০ ফেব্রæয়ারি ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করার ঘোষণা দেন। এদিকে সংগ্রাম পরিষদ এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ ১৪৪ ধারার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আলাপ-আলোচনা শুরু করে দেয়। ২০ ফেব্রæয়ারি সন্ধায় নবাবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যালয়ে এক সভার আহŸান করা হয়। সভায় মূল আলোচনার বিষয়ে পরদিন ২১ ফেব্রæয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হবে কি-না? সভায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আলোচনা করে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। পরে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিষয়টি ভোটে দেয়া হয়। সেখানে ১১ জন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে রায় দেয়। মোহাম্মদ তোয়াহা ভোটদানে বিরত থাকেন।
অপরদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলের ভেতর থেকে ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের নিকট এক ঐতিহাসিক চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ছাত্র সমাজকে আহবান জানান।
২১ ফেব্রæয়ারি সকালে দলে দলে এসে জমায়েত হতে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাতে খাকী হাফপ্যান্ট পরা পুলিশের দল এসে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। তাঁরা কাউকে বের হতে দেবে না। পরিষদ ভবনের দিকেও যেতে দেবে না। ১৪৪ ধারা কোনক্রমেই ভাঙতে দেবে না। কিন্তু ছাত্ররা তা মানবে না। ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের সভাপতিত্বে আমতলায় সভা শুরু হয়।

১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্তের পর ১০ জন ১০ জন করে দলে দলে ছাত্ররা রাস্তায় বের হয়। বিভিন্ন সেøাগান সহকারে ছাত্ররা দলে দলে এগুতে থাকে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে। পুলিশ গিয়ে মিছিল থেকে ছাত্রদের ধরে ট্রাকে তুলে লালবাগ থানায় নিয়ে যেতে থাকে। এতেও মিছিল দমেনি বরং ক্রমশই মিছিল আরও বড় হতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ মিছিলে আক্রমণ চালিয়ে লাঠিচার্জ টিয়ার গ্যাসসহ গুলিবর্ষণ শুরু করে। বেলা ৩-১০ মিনিটের সময় ঢাকার বুকে ঘটে যায় নারকীয় ঘটনা। পুলিশ কোন রকম পূর্ব সঙ্কেত ছাড়াই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরাইশীর নির্দেশে পুলিশ গুলি চালায় মিছিলে। তাতে আবুল বরকত, জব্বার, রফিক, সালাম, সালাউদ্দিন শহীদ হন এবং আহত হন ৯৬ জনের মতো।
এভাবে নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েও বাংলার মানুষকে দমন করতে পারেনি পাক সরকার। বরং একুশের চেতনাকে ধারণ করে বাংলার মানুষ পাক শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভাষার আন্দোলনকে পরিণত করে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালন করা হয়। এ দিনের স্মরণে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি ভাষণ দেন। ওই ভাষণে তিনি বাংলা ভাষার গুরুত্বের পাশাপাশি স্বাধিকারের গুরুত্ব দেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার স্বাধিকারের দাবিও তোলেন।
১৯৫৬ সালে গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোর দাবি তোলেন। এ বছরেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয় সাংবিধানিকভাবে। এ ভাবেই ভাষার লড়াইকে পর্যায়ক্রমে স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর আহŸান ও নেতৃত্বে ৬৬ সালের ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের ছাত্র গণআন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে। সশস্ত্র ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। অফিস-আদালতসহ জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন ও ব্যবহারের নির্দেশ দেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাই স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় প্রথম ভাষণ দেন। এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। তিনি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিকশিত করে বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শক্তিশালী করেন। তার এই ঐতিহাসিক ভ‚মিকা বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাসে সোনালি অক্ষরে লেখা থাকবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। তারা ক্ষমতা দখল করেই একুশের চেতনাভিত্তিক গড়ে ওঠা বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনার ভাবধারার ওপর আঘাত হানে।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে পুনরায় বাঙালী জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে বিকশিত করার কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন। ফলে বাংলা ভাষা ও ২১ ফেব্রæয়ারি বিশ্ব দরবারে ব্যাপক মর্যাদা লাভ করে।
মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার চেষ্টায় বাঙালীর ভাষা দিবস একুশ ফেব্রæয়ারি ও বাংলা ভাষার আবেদন সারা বিশ্বে যখন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন পাকিস্তানী ভাবধারায় বিশ্বাসী একটি মহল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার নামে ভাষা দিবস ও বাঙালীর শিল্প সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। এসব যড়যন্ত্র প্রতিহত করে আমাদের ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালী জাতিকে সুসংগঠিত হতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালি জাঁতি উন্নত সমৃদ্ধ জাঁতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবে। এটাই হোক এবারের একুশের শপথ। (সংক্ষেপিত)



  
  সর্বশেষ
আর্থিক খাতে সংস্কার অব্যাহত থাকবে : অর্থ উপদেষ্টা
বেরিয়ে এলো অভিনেত্রী হিমুর মৃত্যুর চাঞ্চল্যকর তথ্য
স্বৈরাচারের দোসরদের যড়যন্ত্রের বিষয়ে সতর্ক থাকুন : তারেক রহমান
বিএনপি মহাসচিবের সাথে অস্ট্রেলিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের বৈঠক

সম্পাদক : স্মৃতি ভূষণ ভট্টাচার্য্য (স্মৃতিময়)
সম্পাদক কর্তৃক ১১২/২-এ পূর্ব বাসাবো, ঢাকা থেকে প্রকাশিত। তুহিন প্রেস ২১৯/২, ফকিরাপুল (১ম গলি) মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত। বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ২/২, ইডেন কমপ্লেক্স, (৪র্থ তলা) সার্কুলার রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০ ।
ফোন: ০২-৪১০৭০৪৫৬, মোবাইল: ০১৭৯৮-৪৬৬৪৭১।
E-Mail: dainikdhaka5@gmail.com, dailydhaka2003@gmail.com